কবি তমাল শেখরকে দেওয়া সাক্ষাৎকার
১/ “চুম্বনে ভাঙছে রাত্রির অন্ধকার/ ঠোঁটের চাপে
ভেঙে পড়ছে সঙ্ঘ, পরিবার/ পার্টি ভাঙছে, রাজ্য ভাঙছে কথায় কথায়” – ব্যক্তি থেকে
সমাজ সবেতেই তুমি একটা ভাঙন দেখতে পাচ্ছ। তুমি কি হতাশ? ঠিক কীভাবে দেখছ ?
উত্তরঃ এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে লাইনগুলির ভিন্ন
ব্যাখ্যা অসম্ভব কিছু নয়। প্রসঙ্গত বলতে চাই, উদ্ধৃত অংশটি ‘ইচ্ছেপাঠ’
কাব্যগ্রন্থের দীর্ঘ কবিতাটি থেকে তুমি নিয়েছ। এই লেখাটি লেখার সময় বেশ কিছুদিন
আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করছিলাম। নিজেকে আকস্মিক বলে মনে
হচ্ছিল না। মহা সময়ের অংশী বলেই মনে হচ্ছিল। আমি যেন মহাজাতক। আমার পেছনে অজস্র
জন্মের ইতিহাস। শিকড়েরই খোঁজ চলছিল। আবার সমসাময়িক নানা ঘটনায় আমার অস্তিত্বই যেন
প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিল দিন দিন। কবিতাটি শুরুও হয়েছিল এইভাবে, ‘ বৃক্ষমূল থেকে শুরু
করি প্রথম পাঠ/ বাকিসব জমা আগুনে’ । একটা অস্থিরতা অনুভব করছিলাম। ভাঙচুর শুধু যে
নিজের ভেতর, তা নয়। মানুষের সৃষ্ট যাবতীয়ের ভেতরই দেখতে পাচ্ছিলাম; পুরাণ, ইতিহাস,
ভূগোল, সমাজ, ধর্ম, ব্যক্তিসম্পর্ক-- সর্বত্র। একে কি নিরাশা বলা যায়! মনে হয় না।
অজস্র দ্বন্দ্বের ভেতর ছিলাম। দেখবে, ঠিক আগের লাইনগুলিতেই আছে, ‘আমাকে শোনো-/ এ
বাঁশি শুধু মোহ নয়, কামও জানে/ এ বাঁশি সক্ষম উৎপাদনে’। অজস্র বিপরীতমুখী ভাবনায়ও মন ভারাক্রান্ত ছিল। সবকিছুর
মূলে কারণ হিসেবে নিজেই যেন কোনো না কোনো ভাবে আছি, অর্থাৎ, আক্রমণের অভিমুখ নিজের
দিকে। যে পচন সমাজের মধ্যে আছে, নিজের ভেতরেও তার জাইগোটটি খুঁজে পাচ্ছিলাম। এছাড়া, মতাদর্শ বলতে তো কিছু নেই এখন। সকল সম্পর্কগুলিই
জোড়াতালি দেওয়া। ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে দল। স্বার্থে টান পড়ছে, বা
ব্যক্তিগত মনোমালিন্য হল, তো তার প্রভাব পার্টি বা সঙ্ঘে এসে পড়লো। হুড়মুড় করে
তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়লো সব।
২/ ‘মতাদর্শ বলতে তো কিছু নেই এখন’ – তরুণ বিশ্লেষক এবং কবি হিসেবে এটাকে কি তুমি সংকট বলতে চাইবে? না, চাইবে না !
উত্তরঃ নিশ্চয়ই। সংকটই বলব। আজকের পৃথিবীতে সবই বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা একই সাথে টিকিয়ে রাখা যায়
না। প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে তার চরিত্র পাল্টে যায়। চাহিদারও পরিবর্তন হয় দ্রুত। আমরা
কী চাইছি তা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আমরা জানিও না। কোম্পানিগুলি ঠিক করে দেয়। তাই
একটু আগের আমি আর একটু পরের আমির মধ্যে যোজন তফাৎ। পরিণতিহীন এক ধরণের অস্থিরতায়
আমরা কাঁপছি সবসময়। এর হাত থেকে কারও নিস্তার নেই। ‘মতাদর্শ’ শব্দটির অন্তরে
মানবতার ভাবনাটি রয়েছে। আজ তার বড়ও অভাব। মানুষের নির্মম হত্যার যে তুমুল উল্লাস
সমস্ত বিশ্বে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, কোনও
একটি বিশেষ মতাদর্শ তার ভিত্তি, এই কথা বললে তাকে তো আর মেনে নিতে পারি না। গভীরে
রয়েছে বাজার।
৩/ “ডালপালাসমেত
ঝুঁকে যাই তোমার উপর/ বুক খুলে দেখি/ কোথায় জল কোথায় পাথর”—তোমার কবিতার একটি
গুরুত্বপুর্ণ বিষয় প্রকৃতি। প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে ঠিক কীভাবে সংযুক্তিকরণ করে
থাক?
উত্তরঃ সংযুক্তিকরণ
বললেই ছায়ার মত বিযুক্তকরণ শব্দটিও এসে দাঁড়ায়। কিন্তু আমরা তো প্রকৃতি থেকে
বিযুক্ত নই। বরং গভীরভাবে সম্পৃক্ত। শারীরবৃত্তীয় কাজ বাদ দিলেও আমাদের চেতনায়
ভাবনায় কথায় যাপনে প্রকৃতিই তো লগ্ন হয়ে আছে। একে উপেক্ষা করি কীভাবে। আর, আমাদের
রাজ্য প্রকৃতির স্বর্গদুয়ার। চোখ খুললেই পাহাড়, বিশাল আকাশ, ঝরনা, হাওর, বন, নানা
পাখির ডাক; শহরগুলিও চরিত্রে ঠিক শহর হয়ে ওঠেনি। তাই প্রকৃতি নিয়ে আলাদা করে ভাবতে
হয় না, স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়।
৪/ এভাবে বললে তো ‘প্রকৃতি’র সাথে ছায়ার মত ‘বিকৃতি’ শব্দটাও চলে আসে! আমি আসলে ‘আমাদের চেতনায়’ বদলে কবিতায় ‘তোমার চেতনার’ কথা জানতে চেয়েছিলাম?
উত্তরঃ আমি মনে করি নিজের প্রকৃতি সৎ
ভাবে প্রকাশ করাই একজন কবির কাজ। সেই প্রকৃতি নিশ্চিতরূপে অন্তরপ্রকৃতি। করতে গিয়ে
বাইরের উপরেই নির্ভর করতে হয় কবিকে। আর তা সৎ ভাবে প্রকাশ না করতে পারাই বিকৃতি। বাইরের
সঙ্গে ভেতরের অবিরাম সংঘর্ষ চলে, প্রেম চলে। আমি সেসব অনুবাদ করি মাত্র। আর কিছু
না। মনে হয়, এই বিশালতার মাঝখানে আমি কত ছোটো, তুচ্ছ—ধুলোর মত। আমাকে ছাড়াও তার
চলে। আমাকে তার দরকারই নেই। তবু আমি তো আছি। একটা পাথরের দিকে তাকালেও মনে হয় কত
ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে সে। ভীষণ আশ্চর্য লাগে। যেদিকে তাকাই, বিস্ময়ের শেষ নেই। গাছ
পাখি নদী আকাশ মেঘ গ্রহ তারা সব কিছুর ভেতরে অবাক হবার মত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে
প্রতিনিয়ত। একটা রহস্যের গন্ধ পাই
৫/ ‘ত্রিপুরায় বাংলা কবিতা’ তোমার গবেষণাধর্মী বই।
ত্রিপুরার একশ বছরের কবিতাকে দেখেছ তন্ন তন্ন করে। সে নিয়ে তোমার মৌলিক উপলব্ধির
কথা কিছু শুনতে চাই।
উত্তরঃ কাজটি করার
সময় খুব আনন্দ অনুভব করছিলাম। আনন্দ এই কারণে হচ্ছিল যে, ত্রিপুরার রাজ আমল থেকে
শুরু করে অধুনাকাল পর্যন্ত কবিতাচর্চা এই সুবাদে ফিরে দেখার সুযোগ ঘটেছিল। বাংলা
কবিতার হাজার বছরের ঐতিহ্যের ভেতরে ত্রিপুরার কবিতাকে আবিষ্কারের আনন্দই আলাদা।
কষ্টও হচ্ছিল, দেখতে পাচ্ছিলাম বহু মূল্যবান গ্রন্থ অযত্নে, সংরক্ষণের উদাসীনতায়
কালগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের রাজ্যের ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে নিয়ে আমাদেরই কাজ করতে
হবে। যথেষ্ট শ্রম দিয়ে গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে। কোনও সুকুমার সেন বা অশ্রুকুমার
শিকদার আমাদেরকে নিয়ে কাজ করেননি, করবেন না— এই অনুভূতি মনের মধ্যে তোলপাড় করছিল।
৬/ “একবিংশ শতকের
কবিতায় সরাসরি বলা বা মুখ খুলে কথা না বলতে পারার কারণ পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক কারণ”—তোমার
এই উক্তিটির আরো একটু স্পষ্টীকরণ তুমি কি করতে চাইবে ?
উত্তরঃ
বিষয়গুলি সেখানেই বিস্তৃত আলোচনা করেছি। জোট আমলের পরে ত্রিপুরায় মেরুকরণের
রাজনীতি স্পষ্ট চোখে পড়তে থাকে। কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট এই দুই রাজনৈতিক দলের
কর্মকাণ্ড ও তৎপরতা প্রকট হয়ে ওঠে। এই সময়পর্বে রাজনৈতিক আদর্শের বদলে দলীয়
সচেতনতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে ওঠে।
এক্ষেত্রে সর্বস্তরে শাসকদলের নিয়ন্ত্রণ চুড়ান্ত চেহারা নেয় । এ রাজ্যে যুবাদের সরকারি
চাকুরি ব্যতীত কর্মসংস্থানের সুযোগ স্বল্প। সুতরাং চাকুরি প্রত্যাশী যুবারা
রাজনৈতিক দাদার চক্ষুশূল হয়ে, রাজনৈতিক রুচির বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে কথা বলার
ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এই ভয়ের
একমাত্র কারণ। সুতরাং সাহিত্যেও এর প্রভাব পড়েছে। মূলত এটাই বলতে চেয়েছি।
৭/ ত্রিপুরার কয়েকজন কবি তোমার আলোচনায় বাদ পড়েছেন। বিষয়টা নিয়ে কিছু বলতে চাইবে?
উত্তরঃ বিষয়টির জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।
আসলে কাজটি আরও বড়ো ছিল। পৃষ্ঠাসংখ্যা কমাতে গিয়ে অসাবধানবশত এইসব সমস্যা হয়েছে।
এমনকি ককবরক চাকমা মণিপুরি কবিতাচর্চার উপরেও আলোচনা ছিল, এগুলোও বাদ গেছে। অনেক গুণীজন কাজটির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন,
মতামত জানিয়েছেন, উপদেশ দিয়েছেন। পরবর্তী সংস্করণ যদি হয় কখনো, তখন সংশোধনের ইচ্ছা
রয়েছে।
৮/ তোমার কবিতায় ছন্দের খুব পরীক্ষা-নিরীক্ষা
দেখা যায়। প্রথাগত ছন্দ এবং গদ্য কবিতার অন্তর্ভেদকে তুমি কীভাবে মূল্যায়ণ করে থাক
?
উত্তরঃ ছন্দ
কবিতার বাইরের কিছু নয়। একেবারেই অন্তর্লীন বিষয়। একজন কবিকে কবিতার চৌষট্টি কলা
জানতেই হয়। একটা কবিতা তার ম্যুড অনুযায়ী চেহারা নিতে থাকে। প্রথাগত ছন্দে হতে
পারে বা গদ্যে। কবিকে তাই জেনে রাখতে হয় সব পথ। প্রথার ভেতর দিয়ে যেতে যেতেই আসে
প্রথা ভাঙার ইচ্ছা। আর আমরা যে বলি কবিতায় ভাঙচুরের কথা, তা মূলত ছন্দের ভেতর
দিয়েই আসে। প্রত্যেক কবিই কবিতায় নিজস্ব স্বর ও ভাষার অনুসন্ধান করে থাকেন। ছন্দ
সেই ভাষা নির্মাণের প্রধান পথ ও সহায়ক।
৯/ ‘ছন্দ’ আর ‘প্রথাগত ছন্দ’- দুটো শব্দকে কি আমরা গুলিয়ে ফেললাম না? সেই বৃহৎ অর্থে তো গোটা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডই ছন্দে
বাঁধা
উত্তরঃ এক্ষেত্রে যাই বলব, সবই পুনরাবৃত্তির মত শোনাবে। প্রথাগত
ছন্দ বলতে আমি স্থূলভাবে বাংলা কবিতায় ব্যবহৃত ছন্দের কথাই বলতে চেয়েছি। আহ্নিকগতি
থেকে বার্ষিকগতি সবই নিয়ম মেনে চলে—এই অনুশাসনের ইঙ্গিত আমি দিতে চাইনি। এটা আসলে
বাইরে থেকে ছন্দকে দেখা। অনুশাসনের বা নিয়মের নিগড় থেকে ছন্দকে দেখলে মনে হতেই
পারে বিষয়টা বোধ হয় ছকে বাঁধা ব্যায়াম। কিন্তু আদতেই তা নয়। ছন্দ ছাড়া যে কবিতা
হবে না, বা হয় না, তা বলছি না। নির্ভুল ছন্দে লিখলেও কবিতা নাও হতে পারে। কবিতায়
আমরা কী চাই, কেমনভাবে চাই ? বাচ্যের অতীত কোনো জায়গায় নিয়ে যাবার কথা বহুবার
বহুজন বলেছেন। বক্তব্যের ভেতরে না বলা কথার উদ্ভাসন। পাঠককে সেই জায়গায় নিয়ে
যাওয়া, যা তার অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত। শব্দ ও ধ্বনি সহযোগে। ছন্দ এক্ষেত্রে
কবির সহকারির দায়িত্ব পালন করে। আমাদের রাজ্যে রাজ আমল থেকেই ছন্দে কাব্য চর্চা
হলেও ষাট-সত্তরের দশকে এসে মূলত হাংরি কবিদের অটোমেটিক রাইটিংয়ের প্রভাবে প্রথাগত
ছন্দবিমুখ কবিতার চর্চা শুরু হয়েছিল। অবচেতন থেকে উঠে আসা স্বরকেই তখন ধরবার চেষ্টা হয়েছে সরাসরি। অনর্গল কথা বলে
যাওয়া। রাগ ক্ষোভ বিদ্বেষ প্রেম ইচ্ছাকে ফিল্টার না করে সরাসরি বলে দেওয়া। কবির
দিক থেকে এই মুক্তির প্রয়োজন ছিল। এখন অনেকেই আবার ছন্দে ফিরেছেন। এটা কবির নিজস্ব
ব্যাপার। তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়, আমাদের আরাধ্য কবিরা সবাই কম-বেশি ছন্দে
লিখেছেন। একটু আগে তুমি বললে না যে
প্রথাগত ছন্দ আর গদ্য কবিতার কথা— জীবনানন্দ অক্ষরবৃত্তকে অবলম্বন করে তার ভেতরে
পর্বের ধাক্কাকে কমিয়ে দিয়ে প্রায় মানুষের স্বাভাবিক কথা বলার ঢঙে নিয়ে গেছিলেন
তার ভাষাকে। অনেক সময় মনেই হবেনা যে তার ভেতরে কোনও ছন্দ রয়েছে। এখন অনকেই
অক্ষরবৃত্তে লিখছেন, কিন্তু পর্বের শাসন ভেঙে দিচ্ছেন। নানাভাবে নিরীক্ষা হচ্ছে।
বিশ্বের অনেক ভাষাতেই কবিতা এখন ছন্দ পরিহারের দিকে যাচ্ছে। বাংলাতেও অনেকেই তা
করছেন। তবু মনে হয় বাংলা কবিতার আসল শক্তি ছন্দের ভেতরেই রয়েছে। আর প্রথাগত
ছন্দগুলি তো আমরা নির্মাণ করিনি। তার ভেতরে রয়েছে হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস। আমাদের
পয়ার, ছেলে ভুলানো ছড়াগুলো কত না যুগের সময়পর্বের সাক্ষী। একে অস্বীকার করা
ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন