আমার কবিতা ভাবনা / অভিজিৎ চক্রবর্তী
সুর কেটে যায়। বারবার
প্রবাহ কেটে যায়। ভাবি, প্রবাহ কেটে গেলে
যে জেগে ওঠা হবে, তা তো হওয়া উচিত নতুনভাবে। এমনও নয় যে জেগে ওঠাটুকু নতুন হয়নি, কিন্তু তা এত ক্ষণিকের
যে সন্দেহ হয়, নিজের পথ নিয়ে, ভালোবাসা
নিয়ে। কী বলতে চাই আমি? কেনো বলতে চাই
? না বললে কি আমার ব্যথা লাগে ? হ্যাঁ ব্যথা
তো লাগে। কোনো কাজেই মন বসে না। রাগ উঠে যায়। এ যে নিজের অক্ষমতা তা তো বুঝি। নিশ্চয়ই আমার সাধনায় কিছু খামতি আছে। সাধনায় খামতি বলতে
জীবন লগ্নতার অভাব। শুধু খেয়ে ঘুমিয়ে যদি কাটাতে হয় তবে তো কবিতা লেখা যাবে না। এ
এক অদ্ভুত খেলা। জীবনকে যাপন করতে হবে, আবার আলগা হয়ে দেখতেও হবে। যুক্ত হয়ে থাকলে
তো দেখা সম্ভব নয়। এখানে মনে হয় কবিকে নিষ্ঠুর হতে হয়। যেমনভাবে অজস্র মৃত্যুর
স্মৃতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন, যেমনভাবে বোদলেয়ার জান দ্যু ভালের সম্মুখে
নিজেকে ছুরিকাহত করতেও দ্বিধা করেননি, যেমনভাবে জীবনানন্দ ক্রমাগত উপেক্ষা পেতে
পেতেও সরে আসেননি তার লালিত বিশ্বাস থেকে অথবা বিনয় তাচ্ছিল্য করেছিলেন যাবতীয়
সুখ-ঐশ্বর্য। এই রকম তীব্র আবেগ চাই।
মানুষের মৌলিক কিছু বিষয় আছে তার তো
কোনো পরিবর্তন হয় না। কারণ যাই হোক, মানুষের অনুভুতিগুলি সমান। যেমন রাগ, ভয়,
দুঃখ,আনন্দ, বিষাদ ইত্যাদি। কিন্তু আমারও তো নিজের অস্তিত্ব আছে। আমার একটা জীবন
আছে। আমার চেহারা, কথা বলা, চলাফেরা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আচরণ তো অন্যদের চাইতে আলাদা।
তবে আমার ভাবনা, জীবন নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গী তো আলাদা হবেই।
দ্বিতীয় যে কথা তা হল কিভাবে প্রকাশ
করা। পূর্ববর্তী কবিরা যেমন লিখেছেন তেমনভাবে ? এখানেই আসে প্রকরণের কথা। যদিও তা
স্থূলভাবে। প্রকাশের জন্য কবি কার উপর নির্ভর করেন ? ছন্দ? অলঙ্কার? অঙ্গসজ্জা ?
খেয়াল করলে দেখা যাবে সবগুলি বিষয়ই হলো বাহ্যিক। ছন্দ-অলঙ্কারের যত রকমের
বিভিন্নতা থাকুক না কেনো, তা দিয়ে কবিতায় পুরোপুরি নিজস্বতা অর্জন সম্ভব নয়। বা
সম্ভব হলেও নিতান্ত গাঠনিক দিক থেকে। কিন্তু যেহেতু এগুলি প্রাথমিক শর্ত, তাই
কবিকে এগুলো জানতেই হবে। কারণ প্রকাশে নতুনত্ব সৃষ্টি করতে হলে তা আবশ্যিক। কবিকে
কবিতার চৌষট্টি কলা জানতেই হয়। অনেকটা
বেশ্যার মতই। আমাদের দেশের প্রাচীন কামশাস্ত্রে বেশ্যার চৌষট্টি কলায় পারদর্শিতার
কথা বলা হয়ে আছে। কবিকেও জানতে হবে। কে জানে কোন পথে আসে ভ্রমরা। যেদিকে আসে
সেদিকেই কবিকে জমি পেতে দিতে হয়। তাই প্রাচীন কালে কবিকে সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী ভাবা
হতো। কিন্তু কোথাও কবি নিজেকে আটকে রাখবেন না। এইজন্যই কি বলা হয়েছে কবিদের পায়ের
তলায় সর্ষে! কি জানি।
মাঝেমাঝে ভাবি,
এই যে বেঁচে আছি তা কি এমনি এমনি ? কিছুই নেই তার
ভেতরে ? মনে হয় না। একটা গভীর যোগাযোগ আছে সবকিছুর মধ্যে। জাগতিক সব কিছুর মধ্যেই আছে অনন্তের ইঙ্গিত। সবই প্রকাশিত।
প্রকাশিত বলেই উছৃঙ্খল। অজস্র বৈচিত্র্যে ভরা। এই জগত মূর্খ । কবির কাজ হচ্ছে তার মধ্যে শৃঙ্খলা আনয়ন।
জগতের গভীর রহস্যময় ইঙ্গিত অনুধাবন। মূর্খ জগতের ভেতর ভাষার যোগ ঘটানো। এই জন্য
হয়ত কবি নিবিড় হয়ে যান। চুপ হয়ে যান। তাকে নিজেকে ভুলে যেতে হয়। বারবার দূরে যেতে
হয়। কাছে এসে স্থির হয়ে
থাকতে হয়। সবারই ডানা অনন্তের দিকে খোলা। সবই মুক্তির অনুসারী। সবই প্রকাশের দিকে
ধাবমান। কবির ভেতর দিয়েই এই আসা-যাওয়ার অবিরাম ধ্বনি প্রকাশিত হয়। আকাশ আর মাটির
মাঝখানে কবি তাই সংযোগসূত্র। একটা অ্যান্টেনা। যেহেতু কবি হলেন মাধ্যম সুতরাং কবির
প্রস্তুতি থাকতে হয়। প্রতি মুহূর্তে এই যাত্রা চলতে থাকে।
একটা ধোঁয়াশা থেকে যায়। অনন্ত কী? কাকে বলা হচ্ছে অনন্ত! এই কথাটির নানা
ব্যাখ্যা হতে পারে। কারও সঙ্গে কারও সিদ্ধান্ত মিলবে না। এমনকি আমাদের জ্ঞানের
শাখাগুলির ভেতরেও যে স্ব-বিরোধিতা থাকবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। তবু মোটা ভাবে
ভাবলে বলা যায়, প্রতিটি বিষয় বা বস্তু যেমন আমাদের ভাবনার সীমায় আছে তেমনি তার একটি
দিক অসীমের দিকেও আছে। সীমা বা পরিচিত মুখটিকে আমরা জানি। চিনি। অবাক হওয়ারও কিছু
থাকে না। কিন্তু অপিরিচিত দিকটি আবিষ্কারের অপেক্ষা করে। সে অফুরান। তাকে বারবার
আবিষ্কারে সে নতুন নতুন হয়ে ওঠে। এই যে সন্ধানপর্বটি চলতে থাকে, তা-ই অসীমের দিকের
মুখ। এখানে কোনো নৈতিকতার স্থান নেই। আলোর দিক যেমন আছে, তেমনি বিষয়টির অন্ধকার
দিকও আছে। আলোয় তো সব কিছু মোটাভাবে ধরা পড়ে। কবির কাজ হচ্ছে অন্ধকারের ভাষ্য খুঁজে
আনা। জন্মের মধ্যে মৃত্যুর সত্যতা, আলোতে অন্ধকারের মুক্তি, শান্তির ভেতর অশান্তির
বাস্তবতা অনুভব করেন কবি। কীটের বুকের ব্যথা এভাবেই কবি অনুভব করেন।
তাই যে জিনিসটি সংক্ষিপ্ত, তাকে কবি অনর্থক বড়ো করে দেখেন, যা বড়ো তাকে হয়তো
কবি পাত্তাই দিলেন না। একধরণের মিথ্যাচার। প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের জায়গা
দেননি। যেহেতু কবি সন্দেহের ও রহস্যময়তার ভেতর দিয়ে যাত্রা করেন, তাই তার
কথাগুলিকে মনে হয় আপাত মিথ্যা। সত্যের অনুভব পাঠকের মনে জাগিয়ে তোলার জন্যই এই
মিথ্যা। আপাতদৃষ্টিতে যাকে সত্য বলে ভাবা যায় তাও কোনো অন্য অবস্থান থেকে দেখলে বা
গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে মিথ্যা বলেই প্রতিভাত হতে পারে। বা ভাবা যেতে পারে কোনো
অবস্থানই সত্য নয়। অথবা সবগুলি অবস্থানই মিথ্যা। কবি তাই কোনো পক্ষেই দাঁড়ান না। আদর্শ
রাষ্ট্র সব সময়ই কবিকে ভয় পাবে, বা বুঝবে না। রাষ্ট্র চায় কবি তার প্রশস্তি পাঠ
করুক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি কবি কারো পক্ষে না থাকেন, তবে রাষ্ট্রের পক্ষেও
থাকবেন না। আর রাষ্ট্রের পক্ষে তা খুব সুখকর নয়। কবি যদি পৃথক অবস্থান নেন, যাকে
নিরপেক্ষ ভাবা যায়, তবে তিনি সব ব্যাপারে যে রাষ্ট্রকে সমর্থন জানাবেন তা একটি
অলীক ভাবনা। রাষ্ট্র যখন দেখাবে
আলোক, কবি টেনে এনে দেখাবেন ভেতরের অন্ধকার। তা অরাজক বা নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে
রাষ্ট্রের দিক থেকে। তার সার্বভৌমত্ব ও
জাতীয়তাবোধ নামক প্রোপাগান্ডায় আঘাত হানতে পারে।
এই যেমন লেখাটি লিখতে গিয়ে অজস্র কথা বলছি আমি, যা অপ্রাসঙ্গিক ও এলোমেলো।
কবিতা লেখার মধ্যেও এমনি অবান্তরতা থেকে যায়। কেঁটেছেঁটে বাদ দিতে হয়। এই
পরিমার্জনও একটা বিষয়। যেটা বারবার করতে পারেন কবি। যতদিন কবি জীবিত থাকবেন। এভাবে
কবিতাটি হয়তো সময়োপযোগী হয়ে ওঠে। যেখানে আবর্জনার ডাঁই পড়ে আছে, সেখানে লোহা লক্কর
সরিয়ে কবি পেলেন রক্তকরবীর আভাস।
এসব বিষয় তো পথ নির্মাণের। কিন্তু
কীভাবে লিখব? যেহেতু প্রবাহ কেটে যায়, তাই বুঝতে পারি যেভাবে লিখছি সেটা আমার নয়।
আমার অস্তিত্ব আমার কাছেই এখনো স্পষ্ট হয়নি! বেঁচে যে আছি তা আমার কাছেও
অবিশ্বাসের হয়ে উঠছে। এত নির্লিপ্তি আসে কীভাবে? মোদ্দা কথা কোনটা আমার নিজস্ব পথ।
তবে কেউই তো দৃশ্যগতভাবে পথের ব্যাখ্যা করতে পারেন না। কবিতাকে দুটি দিকে তার
বক্তব্যকে তুলে ধরতে হবে একইসঙ্গে। এক হলো, তাকে সাধারণ পাঠকের কাছেও বিশ্বাসযোগ্য
হয়ে উঠতে হবে; দুই, একজন মননশীল পাঠকেরও ভাবনার উপাদান থাকতে হবে এতে। সবার আগে
কবিতাকে হয়ে উঠতে হবে শ্রুতিমধুর। এখানে
একটা বিষয় তীব্রভাবে বলতে চাই, শ্রুতিমধুর মানে পেলবতা নয়। কোমলতা নয়। শ্রুতিমধুর
মানে সামঞ্জস্যতা। একটি কবিতার প্রথম লাইন থেকেই তার প্রতিবেশ রচনা হয়ে যায়। পাঠকের
কানও সেইভাবে প্রস্তুত হয়ে ওঠে। পাঠককে
মননে আঘাত দেওয়া যায়, কিন্তু হৃদয়ে নয়। আপাত বিশৃঙ্খলতার ভেতরেও চাই শৃঙ্খলা।
অনেকটা আমাদের এই জগতের মতো। মনে হয়, জগতের প্রতিটি জিনিস আলাদা আলাদা। কারো সঙ্গে
কারো যোগ নেই। সবারই ভিন্নতর চরিত্র। কিন্তু, অন্তরালে রয়ে গেছে এক অসীম যোগ। তাই
চোখে এই অমিত ভিন্নতা সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে দেখা দেয়। বরং এক ধরণের মায়ার
কার্য-কারণে গাঁথা। এমনকি পরস্পরবিরোধী চরিত্রেরাও ভিড় করে আছে এখানে। একেবারে
বাঘে গরুতে একঘাটে জল খাওয়ানোর মতো অতি স্বাভাবিক। জলপানরত বাঘ ও গরু যেমন চরিত্রে
একক অর্থাৎ চরিত্রহীন তেমনি কবিতায় শব্দেরও হয় একই দশা। বিভিন্ন পরস্পর বিপরীতমুখী
শব্দকে নিয়ে গাঁটছড়া বাঁধেন কবি। তাকে ভিন্নতর পরিবেশ দেন। এখানে শব্দের সম্ভাবনাও
খুলে যায়। কিন্তু এ তো গেলো অর্থের কথা। কিন্তু ধ্বনির কথাও উপেক্ষণীয় নয়। কানে
যেন এমন খটকা না লাগে, যাতে কবিতার আবহটি মার খায়। তাই কবিতাকে শ্রুতিমধুর করে
তোলা কবির কাজ। যে কবিতা একেবারে কোমল সেখানে হঠাৎ ভারী শব্দের আমদানী হলে পাঠকের
কান ও চোখ সেই শব্দতে আটকে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কবিতার আবেদনের চাইতে তখন বড়ো হয়ে
ওঠে শব্দটি। তাই কবিতা হয়ে যায় গৌণ। ছন্দের পর্বসাম্যতা বা লয় ও ছন্দস্পন্দের
অন্তর্গত মিল এক্ষেত্রে কবিকে সহায়তা করতে পারে। তবে এখন গদ্যের বাকভঙ্গি বজায় রেখেই
ছন্দে লেখার নিরীক্ষা চলছে। জীবনানন্দ এ বিষয়ে কাজ করেছেন গভীরভাবে। তিনি অজস্র
কবিতায় মাত্রাসাম্যতা রাখলেও পর্বসাম্যতা রাখেননি। আবার পর্বসাম্য বা মাত্রাসাম্যও
বজায় না রেখেও নির্দিষ্ট ছন্দের পর্ব গণনার সংখ্যা বজায় রেখে কবিতা লিখেছেন। মধুসূদন
বাংলা কবিতায় যে মুক্তির সূচনা করেছিলেন, জীবনানন্দ তাকে দিয়েছেন উদ্দামতা। কিন্তু কথার প্রবাহ বা গতির অপরূপ
সামঞ্জস্যতা হারাননি কেউই।
বাংলা কবিতার মূল সুর রোমান্টিক। আমাদের লোকগান ভাটিয়ালী পদাবলী
সবকিছুর মধ্যেই একটা বিষাদভারাক্রান্ত সুর রয়েছে। আধুনিকতার নিরীক্ষায় এই সুরে আঘাত হানা হয়েছে বারবার। কিন্তু এখনও রোমান্টিকতা বাঙালিকে
সুড়সুড়ি দেয়। জলের মত স্বচ্ছ আমাদের ভাষা। কোনো মলিনতা নাই। তাই এই ভাষায় গানের এতো প্রভূত ঐশ্বর্য, এতো দীর্ঘ ইতিহাস। আমাদের চর্যাপদ থেকে আরম্ভ করে মধ্যযুগের
বিস্তৃত ইতিহাসতো গানেরই সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ নজরুল গান লিখে
যত সাধারণের কাছে যেতে পেরছেন, কবিতার জন্য তত নয়। অসীমতার দিকে যাত্রা রোমান্টিকতার একটি আবশ্যিক শর্ত। গানে যা সহজেই হয়। পাঠক বা শ্রোতামাত্রেই ছুঁতে পারে
সেই সম্ভাবনার দরজা। কোনটি আমার পথ তবে ? কীভাবে যাব আমি
? আসলে প্রকাশেই আসবে নতুনত্ব। একটু অন্যরকম লেখা যা আমার নিজস্ব। ছন্দকে ভেঙেচুরে লেখা যায়। কিন্তু আমি চাই বিষয়েও অভিনবত্ব। একটু অন্যরকমভাবে দেখা। বলার স্টাইল পাল্টে দেওয়া। কিন্তু এ আমি বিশ্বাস করিনা যে মানুষের কথার চলন ভেঙে দিলে কাজের কাজ হবে।
কথার চাল বজায় রেখেই ভঙ্গী পরিবর্তন করা যেতে পারে। কোনো আরোপিত বা যান্ত্রিক
প্রয়াস নয়। কাটকাটভাবে লাইনগুলি এগোতে পারে, কিন্তু তার মধ্যেও অপ্রত্যাশিত হলেও
বলার একটা স্বাভাবিক সহজ সৌকর্য থাকবে। নানান নিরীক্ষা হয়েছে ভাষা নিয়ে। কিন্তু
প্রায় ক্ষেত্রেই ভাষা নতুনত্বের মুখোমুখি দাঁড়ালেও কবিতার আবেদন নষ্ট হয়েছে।
কিন্তু মনে হয় কবিতার কাজ ভাষার ব্যায়াম নয়। আগে তো পাঠকের সঙ্গে তার যোগাযোগ হতে
হবে। আর ভাষা এক্ষেত্রে মাধ্যম। বিচ্ছিন্নতার সমুদ্র নয়। সেতুপথ রচনার জায়গায় যদি
ভাষা হয় অন্তরায়, তবে মস্তিষ্ক অনুশীলন ছাড়া আর কিছুই প্রাপ্তি হয় না।
আমি কোন সমাজে আছি ? আমাকে ঘিরে কারা আমার পরিবেশটি রচনা করে দিয়েছে ? একেবারে
ঘিরে যারা আছে তাদের জীবন, লড়াই, সমঝোতা,
ছক বাঁধা আর ছক ভেঙে ফেলা দেখি আমি। প্রতিদিন দেখি। বারবার অপমানিত হই নানাভাবে। আমার ব্যক্তিত্ব যেন হাওয়ায় মিশে গেছে। দেখি লোভ, হিংসার রঙ। পাপ বা পূণ্য কিছুই নেই বুঝতে পারি। দেখি, কিভাবে নষ্টরাই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে, যায়। আসলে শয়তানেরই জয় হয় বারবার। সুন্দরের জন্য প্রার্থনা চলে, কিন্তু জয় কুৎসিতের। জীবনানন্দ বলেছিলেন সৃষ্টির মনের
কথা মনে হয় দ্বেষ। স্ট্রাগল ফর একজিস্টেন্সের
ভেতরেও রয়েছে সেই কথা; রক্তপাত, খুনোখুনি, ক্ষমতার অন্ধকার। ভালোবাসা ও যুদ্ধের জন্য
সবকিছু চলে-- এই আপ্তবাক্যের কাছে তাই পর্যদুস্ত আমাদের যাবতীয় ভালোমানুষি, নৈতিকতা। সুতরাং মানুষ এক আদীম ও ভয়াল জীব
ছাড়া কিছুই নয়। যেকোন মুহূর্তে সে খাবলে
তুলতে পারে তার পরিবারে বাড়তে থাকা পোষ্যটির মাংস। নির্দ্বিধায় সে খেতে পারে। এমনকি একবারের জন্যও তার মনে নাও পড়তে পারে এতদিনের স্মৃতি। তবু মানুষ কাঁদে। তার অশ্রু ও রক্ত দুই চোখেই রয়েছে। একটি গুন্ডা বা ডন কোনো হত্যাদৃশ্য
বা দুঃখের দৃশ্য সিনেমায় দেখে আহত হয়, কেঁদে
ফেলে। তার মনও নায়কের পক্ষে দাঁড়ায়, সত্যের পক্ষে দাড়াঁয়। এই বৈপরীত্য তার চরিত্রেই আছে। ভালো, মন্দ, খুনী, দালাল, ভোগী ও ত্যাগী। কবি দাঁড়ান এ সবের মাঝখানে। কবিতার কাজও সেইখানে।
এতক্ষণ যে কথাগুলি বললাম তা সাধারণ কথা। নতুন কিছু নয়। সব কবিই এর বেশিরভাগ অংশের সঙ্গে সহমত হবেন। কিন্তু আমি কী চাই, বললে আমাকে পেছনে তাকাতে হয়। কেন জানি মনে পড়ছে আমার শৈশবের কিছু
স্মৃতি। আসলে স্মৃতিই মনে হয় কারোকারো কবিতার
থেকে অন্যের কবিতাকে আলাদা করে তোলে। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে
একটি হালকা সবুজ রঙচটা ভাঙা স্কুটার। উপরে করবী গাছ। ভাবি, কীভাবে এই অনিন্দ্যসুন্দর ছবিকে
আমি প্রকাশ করব? কেনো আমার ভালো লাগছে এই স্মৃতিটি? কি আছে এর ভেতরে? এ কি শুধুই
ছবি? রোদ বৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্কুটার কীভাবে এতটা দিন চুপ করে আছে আমার
মনের মধ্যে? অথবা আজকের কোনো ঘটনা। তাও তো স্মৃতিই। এটা কোনো দৃশ্য হতে পারে, হতে
পারে কোনো কোনো বিষয়। এইমাত্র যে লোক্টি চলে গেলো তার অস্পষ্ট ছায়াঘন মুখ, এই
অপরিচিতির আনন্দ। এর
মতই কবিতার সুখ। মনে হয় সবই আসলে শুরু। শেষ কবি নিজেও জানেন না। এখানেই আবিষ্কারের
আনন্দ। যেন প্রতিটিই এক একটি হিমশৈলের চূড়া। যার যাওয়া অনন্তের দিকেই। যেখান থেকে
ইচ্ছা শুরু করা যেতে পারে। আসলে চিরকালীন কবিতার কোনো টেকনিক থাকে না। এখানে
কেউকেউ বলতে পারেন স্মরণযোগ্যতার কথা। কিন্তু স্মরণযোগ্যতা চিরকালীনতার একমাত্র
শর্ত নয়। আরো অনেক কিছু থাকে। কী সেই জাদু? কবি নিজেও জানেন না। তার সমস্ত থিওরি
দিয়েও এর ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। অজস্র কালোত্তীর্ণ কবিতা পাশাপাশি নিলেও দেখা যাবে
একটির সঙ্গে আরেকটির শৈলী মিলছে না। অনেক কবিতায় কবির একটি ভুলও নান্দনিক হয়ে ওঠে।
চিরকালীন কবিতা শুধু একটি মানুষ বা যুগের আধার নয়। তার মধ্যে অনন্তের আসা যাওয়ার
পথ খোলা থাকে। অজস্র অনুশীলনের ভেতরই অসতর্ক তার আবিষ্কার। এর জন্য কবিকে অপেক্ষা করতে হয়। যেখানে শব্দ, শব্দের ফাঁক,
স্পেস, এমনকি যতিচিহ্নগুলিও বেজে ওঠে। একটি চিরকালীন কবিতায় নীরবতারও ভাষা টের পান
পাঠক। কবিতা নয়, পাঠক বেজে ওঠেন। যা বলেননি কবি তাও অনুভব করেন তিনি। এ ধরণের
কবিতা অনেকটা সারারাত ধরে জমতে থাকা শিশিরবিন্দুর মত, হাতে নিলেই যার চরিত্র নষ্ট
হয়ে যায়। এমনই সংবেদনশীল ও পবিত্র। পাঠকের তৃপ্তি বারবার পাঠে নতুন দিশা খুঁজে
পায়। অজস্র পথেই তার উদ্ভাস। কবি যেখানে নিজেকেও ভুলে যান। এখন যেমন বৃষ্টি পড়ছে,
এবং তা দেখে আমার খুশি লাগছে। মনে হয় এর চাইতে আধুনিক আর নতুন আর কিছুই নেই। এ যেন
চিরকালীন। যার কোনো থিওরি নেই। কবিতাকেও এই রোদ বৃষ্টির মত চিরকালীন হতে হবে। ঐ অনর্থক
ভাঙা স্কুটারটি যেমন শত ঝঞ্ঝার মধ্যেও মনে বেঁচে থাকছে অনন্তকাল, ঠিক তেমনই।
খুব ভালো লাগলো দাদা। অনেক কিছু জানলাম ।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ মৌসুমি
মুছুনRabindranath -er cheye apnar lekha porar jonno exited thaki.....😊 😍
উত্তরমুছুন